“আমাদের
কথা”
বসন্তের শুরুতে যেমন নানা নতুন ফুলের কুঁড়ির সৃষ্টি হয়, তেমনি এক বসন্তের
শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় নতুন স্বপ্ন ও সবুজ তারন্য নিয়ে আমাদের পদচারণা
শুরু হয়। কালের পরিবর্তনে আজ আমরা পরিণত মানুষ হয়েছি, আর
তাই জগতের নিয়মে আমাদের এই ছাত্রজীবনের আঙিনা ছেড়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হবে।
কিন্তু তবু ফেলে আসা সেই সোনালী দিন গুলো বার বার মনে হবে। আমাদের প্রতিদিনের সেই
ঘটনা গুলো নিয়েই লেখা – “আমাদের কথা”।
১
সেমিস্টারের শুরুতেই ইভেন-ওড গ্রুপ ল্যাব নিয়ে
অ্যানালাইসিস শুরু হয়ে যেত। কবে কোন গ্রুপ
ল্যাব করবে। তবে ওড গ্রুপ যত ভাল দিনটিই বেছে নিত না কেন কপাল সব সময় ইভেন
গ্রুপেরই ভাল থাকত। আর ইভেন গ্রুপের ল্যাব বেশী হত বলাই-দার ল্যাব। আর বলাই-দার
ল্যাব মানেই সাজানো-গোছানো পরিবেশ, সেই সাথে বলাই-দার বিশেষ রিং
টোন।
২
স্যার ক্লাস নিচ্ছিন, হয়ত পাঁচ ছয় মিনিট হয়েছে। এমন সময় সঞ্জয়, মাশরিক,
রিজুল, সাজিদ, ফাহিম, ফখরুল এরা আস্তে করে দরজা খুলে ক্লাসে ঢুকল। সবাই ঘেমে ভিজে আছে।
স্যার হয়ত বিষয়টা খেয়ালই করেননি। কিন্তু ক্লাসে ঢুকতে না ঢুকতেই সবাই চিত্কার করে
উঠল, “কী সঞ্জয় টি টি (টেবিল টেনিস) খেলে আসলে ... ”। চার-পাঁচ জন ক্লাসে ঢুকল কিন্তু সবাই সঞ্জয়ের নামটাই বলল। এভাবে আমরা নানা কারনে–অকারনে সঞ্জয়কে ফেভারেট করে
তুলতাম। আর ২০১৩ সালের পিকনিকের কথা না হয় নাই বললাম।
৩
স্যারের ক্লাস নেওয়া শেষ। এবার রোল কল হবে। এমন
সময় আমাদের সর্বময় লেট বন্ধু ইভান এসে ক্লাসে ঢুকল। “স্যার-স্যার, আগেই এসেছিলাম কিন্তু কিছুটা লেট
হয়ে গেল, রাস্তায়-রাস্তায় যে জ্যাম।” – আর সাথে সাথে আমরা চিত্কার করে উঠি। “না স্যার,
ওরে আটেন্ডেস দিবেন না। ও সবসময় লেট করে।” কথাটি আমদের না বললেও হত। কারন, সব টিচারই
দুই-তিন দিন ক্লাস নেওয়ার পর থেকে এমনতেই ইভানকে চিনে যায়। তবু আমরা চিত্কার করে
বলতাম, কারন এর মাঝে এক আনন্দ থাকত। আর আমদের এই বন্ধুটির
99% ই ভাল, তবে একটু লেট করে।
৫
প্রায় প্রতিদিন ল্যাব থাকায় দুপুরে সবাই কোথাও না
কোথাও খেতে যেতাম। প্রথম দিকে শুধু জগন্নাথ আর শহীদুল্লাহ হলে খাওয়া দাওয়া করলেও, পরে তাতে বৈচিত্র আসে; কখনও পুষ্টিতে আবার
কখনও nescafe ক্যাফে(মেডিকেলের বিপরীতে ছিল)। পরে অবশ্য স্যাইন্স
ক্যাফেতেই আমাদের (রিয়েল, শাহরিয়ার, শাওন, অনি, জীবন,
মুবারক ভাই) বেশী খাওয়া হত। তারপরও সময় থাকলে হাকিম চত্বরে চলে
যেতাম। আবার বৃষ্টি থাকলে রসায়নের ক্যান্টিনে খিচুরী খেতে যেতাম। আর বিশেষ কিছু
হলেই হাজির হয়ে যেতাম চানখাঁর পুলে।
৬
ক্লাসে কখনো কোন ব্যবসা বা E-Shop বা শাড়ির কথা উঠলেই সবাই বলত স্বপ্নিলের “নববধূ” কাপড়ের ব্যবসার কথা। আর সেই ব্যবসার
মডেল ছিল তামান্না। আর ক্লাসের হট ফেভারের্ট মুভি Singham HD. ব্যবসা বা ব্যাংকি
এর যেকোন পরামর্শের জন্য স্বপ্নিলের হেল্পলাইন সর্বদা খোলা।
৭
“সি এস ই” এর ল্যাব - মানেই কিছুটা আতঙ্ক। কি
প্রবলেম দিবে আর সেটার জন্য সময় কতক্ষণ? কালকে কি দেখানো যাবে? এইসব প্রশ্ন যার
মনে নেই, তারও কিছুটা আতঙ্ক থাকে। সেটা হল – ভাল একটা কম্পিউটারে বসা। সীট দখল
করার জন্য অনেকে ল্যাবের দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকত। আর যে বেচারা/বেচারী কোড কপি করতো,
তার মনের মাঝে রীতিমত আতঙ্কের ঝড় বইতে থাকত।
৮
জীবনে বোরিং ক্লাস কম হয়নি। আর এইরূপ ক্লাসে সবাই
মোটামুটি বসে থাকতে থাকতে ঘুমে ঝমিয়ে পড়ত। কিন্তু জহর আর শাহরিয়ার কথা আলাদা। তারা
প্রায় সব ক্লাসেই এক আধটুকু ঘুমায়। আর দীর্ঘ লেকচারের কোন ক্লাস হলে ঘুমে একেবারে
কাদা হয়ে থাকত। টিচার ডাকতে থাকলেও খবর হত না। এমনকি ক্লাস চলাকালীন সময় সবার
সামনের চেয়ারটিতে বসে ঘুমোনোর রেকর্ডও জহরের আছে।
৯
ক্লাস হবে আর কথা হবে না, তা কি কখনও হয়? তেমনি কোন ক্লাসে স্যার যদি
আমাদের উপর বিরক্ত হয়ে বলত “কে কথা বলে? কে কথা বলে?” সবাই তখন বলত “স্যার শিহাব, শিহাব” অথবা
“স্যার সঞ্জয়, সঞ্জয়” অথবা “এই শিহাব চুপ কর। এত কিসের কথা”। দীর্ঘ ক্লাস গুলোতে তো সবাই কথা বলত, কিন্তু
তবু শুধু তাদের নামটাই শোনা যেত ।
১০
ক্লাসে টিচার যখন বোর্ডে কিছু লিখত কিন্তু তা
বুঝা যাচ্ছেনা তখন সবাই সমস্বরে বলে উঠতাম “স্যার দেখা যায় না।“ ইস, আমরা কতই মনযোগী ছিলাম। অথচ টিচার যখন
বোর্ডে স্পষ্ট লেখায় পাঠ্য বস্তু সুষ্ঠ ভাবে বুঝাতেন তখন শতকরা ২০ ভাগের বেশী কেউ
লিখত না।
১১
খুবই কঠিন কোন বিষয়ের উপর হয়ত আরো কঠিন এক লেকচার
হচ্ছে। ফলে আমাদের মাথার টাওয়ার কিছুই ধরতে পারছে না, সবই টাওয়ারের উপর দিয়ে যাচ্ছি। দুই একজন কিছু না বুঝে শুধু লিখছে আর
সবাই গুনগুন করে কথা বলছে। ফলে আকাশ হয়ত স্যারের কিছু কথা মিস করল, আর সে এটা আবার স্যারকে বলতে বলছে। এমন সময় সবাই চিত্কার করে উঠত “এই চুপ, চুপ। আকাশ প্রশ্ন করছে। সবাই চুপ কর।“
আর আকাশ কিছুটা লজ্জা আর রাগ করত, কিন্তু
সবসময় একটা হাসি দিয়ে সে শুধু লজ্জাটাই প্রকাশ করত।
১২
পরীক্ষার আগে ১৫ দিনের ছুটি দিত। (যাকে PL /
Preparation level বলা হত)। ৪-৫ মাস ক্লাস করার পর বন্ধ পেয়ে
প্রথম ৩ দিন ঘুমিয়ে কেটে যেত। তারপরের ৩ দিন ফি দেওয়া, ফরম
পূরন করা, হলে যাওয়া – এইসব করতে
করতে চলে যেত। তারপরের ৩ দিন চলে যেত স্যার কি পড়িয়েছেন, কোনটা
পড়তে হবে, কোনটা ফটোকপি করতে হবে - এইসব করতে করতে।
ইনকোর্স পরীক্ষায় তো সব প্রশ্ন লেখা হত না, আসলে উত্তর কি
তাই জানতাম না। তারপরের ৩ দিন চলে যেত সেই সব উত্তর খুঁজে বের করতে। যাক অনেক কাজ
হল। এইবার ২ দিন ঘুমিয়ে নিতে হবে। ৩+৩+৩+৩+২ = ১৪ দিন শেষ। তারমানে পরীক্ষার আগের
দিন হাজির। এইবার আর কি করা ... ধুমসে পড়া।
১৩
পরীক্ষা শেষ করে হল থেকে বের হলে সবার মাঝেই
কিছুটা হতাশা থাকত। “ইস যদি আরেকটু পড়তাম।” “যদি
আরেকটু সময় পেতাম।” আবার অনেকে খুশি হত। “এক রাত পড়েই এত কিছু লিখে ফেলেছি, আর কি
দরকার!” সে যাই হোক, সময়ের সাথে
সাথে সবারই সেই আফসোস শেষ হত। কিন্তু সুজনের আফসোস শেষ হত না। বাসায় পৌছানোর আগে
পর্যন্ত তার নানা প্রকারের আফসোস শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যেত। পড়ে যখন
রেজাল্ট দিত তখন দেখা যেত আফসোসের সংখ্যার তুলনায় তার নম্বরের সংখ্যাই বেশী হত।
১৪
ক্লাসের সামনের সোফাটা বা পুষ্টির ক্যান্টিন বা
চায়ের দোকানটা যেন আমাদের আড্ডার জায়গা ছিল। নানা বিষয় নিয়ে আড্ডা হত। যদিও তাতে
ক্লাসের পড়ার বিষয় কমই থাকত। অনেক সময় আড্ডার বিষয় হেঁটে হেঁটে যেন আমাদের সামনেই
এসে পড়ত। যেমনঃ কোন টিচার, কোন ছাত্র, কোন ... থাক
বললাম না।
১৫
“মানুষ মরে গেলে পচে যায়,
বেঁচে থাকলে বদলায়, কারনে অকারনে বদলায়
...” আর আমরা পরীক্ষা ভাল হলে ট্রিট চাই, পরীক্ষা খারাপ হলে ট্রিট চাই, কারনে অকারনে
ট্রিট চাই। কখনো কোন বন্ধুর বাসায়, কখনো স্টারে, আবার কখনো সবুজ ঘেরা চারুকলার আঙিনায়। আবার কখনো চারুকলার এক্সিবিশন
রুমে ছবি দেখতে যেতাম। যদিও ছবি গুলোর অর্থ কিছুই বুঝতাম না। আর একুশের বই মেলার
কথা তো কখনো ভুলতে পারব না। জীবনের সাথে প্রতি সপ্তাহে একবার যেতাম, আবার অনেকে প্রতিদিন যেত। তবে বই কেনা হত না। শুধুই ঘুরে বেড়ানো,
নতুন বইয়ের মলাট গুলো উল্টিয়ে দেখা, আর
নতুন কোন পরীর সন্ধান করা।
১৬
নিঃসন্দেহে সবচেয়ে আনন্দের মুহুর্ত ছিল যখন কেউ
বলত “কাল পরীক্ষা হবে না” “কাল ল্যাব/ক্লাস হবে না”। তবে পরীক্ষা পিছিয়ে আসলে তেমন একটা লাভ হত না। যারা ভাল করার কথা সব
সময় তারাই ভাল করত। আর সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত আনন্দের ঘটনা হত, যখন ল্যাব চলাকালীন সময় লোডশেডিং হত। সবার কি ভাব! “ইস কোডটা হয়েই গিয়েছিল কিন্তু সেভ করা হলনা।”
এই ছোট ঘটনা
গুলো আহামরি কিছু না। এগুলো আমাদের ক্লাসে প্রায় রোজই হত। কিন্তু আজ যখন এই চার
বছরের জীবনের কথা ভাবতে যাচ্ছি, প্রতিদিনের এই ছোট ছোট ঘটনা গুলোই আতশ কাঁচ দিয়ে
যেন অনেক বড় হয়ে উঠছে।
“হারিয়ে যাওয়া আলোর মাঝে কণা কণা কুড়িয়ে
পেলেম যারে
রইল গাঁথা মোর জীবনের হারে।
সেই-যে আমার জোড়া-দেওয়া ছিন্ন দিনের খন্ড আলোর মালা
সেই নিয়ে আজ সাজাই আমার থালা। ।। ”
--কবি গুরু
ভার্সিটির দিন গুলো আসলেই অনেক সুন্দর হয়।
উত্তরমুছুন