32!
লাল কালিতে লেখা ৩২। খুবই
দক্ষ হাতের লেখা। এর সাথেই আরো অনেক সংখ্যা আছে। সংখ্যা গুলো কিলবিল করে
নাচছে। কেবল বড় হচ্ছে, আর ছোট হচ্ছে। সেই সাথে সাথে সংখ্যা গুলো যেন বিদ্রুপের
হাসি হাসছে। হঠাৎ লাল কালির শূন্য সব গুলো সংখ্যাকে গিলে খেতে শুরু করল। শূন্যতে
সব হারিয়ে যাচ্ছে। সব কিছু তলিয়ে যাচ্ছে ... ...
রাজুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। মাথার
উপর ফ্যান ঘুরছে। তবু তার সারা শরীর ঘেমে গেছে। স্বপ্নে সে কেবল সংখ্যা দেখেছে । কোন ভূত নয়, প্রেত নয়, রাক্ষস নয়। কেবলই সংখ্যা। লাল কালির সংখ্যা। লাল কালির লেখাটা এখনো তার চোখে ভাসছে। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রানরসায়নে মাস্টার্স শেষ করে এখন কানাডা যাওয়ার প্রস্তুতিও প্রায়
শেষের দিকে। গত দশ বছর ধরে যে দুঃস্বপ্নটি মাঝে মাঝেই তার সুখের ঘুম ভেঙ্গে দিয়েছে,
হয়ত দেশের বাইরে গেলেও তা থেকে সে মুক্তি পাবে না।
১০ বছর আগের কথা।
সকাল বেলা। ক্লাস নাইনের
ক্লাসরুমে সবাই চুপ করে বসে আছে। কেউ কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। কারন, ক্লাস শুরু
হতেই দিবা শাখার হারুন স্যার পরীক্ষার ইংরেজি খাতা নিয়ে ক্লাস রুমে হাজির। খাতা
দেখানো হবে। স্যারের যে সুনাম, তাতেই সবাই বুঝে গেছে কপালে কি আছে।
একজন একজন করে খাতা দিচ্ছে,
আর খাতার নম্বর দেখে সবাই মাথা নিচু করে বেঞ্চে গিয়ে বসছে। সবাই যে নম্বর পাবে আশা
করছিল, প্রাপ্তির পরিমাণ তার চেয়ে কমই আসছে। ক্লাসের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, স্যার
সবাইকে নম্বর দান করছে, আর সবাই ভিক্ষুকের মত যা পেল তাই মাথা পেতে গ্রহন করছে। পরীক্ষায়
নম্বর পাওয়া ছাতেদের অধিকার নাকি শিক্ষকের করুণা তা আজো ছাত্র সমাজে অজানাই থেকেই গেল।
কেউ কেউ আবার সেই করুণা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। তারমানে, পাশ নম্বরও কপালে জুটছে না।
রাজু সেকেন্ড বেঞ্চে বসে আছে।
ক্লাসের মাঝে তার অবস্থানও সেকেন্ড। বাকিদের নাম্বার দেখে তার যে ভয় করছে না, তা
নয়। কিন্তু তবু সে ভাবছে তার ক্ষেত্রে ভাগ্য নিষ্ঠুর হবে না। কারন,
পরীক্ষা সে ভাল ভাবেই দিয়েছে। ১০০ নম্বর উত্তর করেছে। প্যারাগ্রাপ, লেটার,
রি-এরেঞ্জ, ডায়ালগ – এইগুলো থেকেই ভাল নাম্বার আসবে, তাছাড়া প্যাসেজে তো ৪০
নাম্বার আছেই।
হারুন স্যার খাতাটি হাতে নিয়ে
হাসি মুখে রাজুকে ডাকে।
স্যারঃ তোমার রোল কত?
রাজুঃ দুই।
স্যারঃ হুম। সামনের বার আর
দ্বিতীয় হওয়ার চেস্টা করে লাভ নাই। এই নাও খাতা।
খাতা দেখে রাজুর চোখ তো চড়ক
গাছে। মাত্র ৩২। পাশ নাম্বারও হল না। এইটা কি করে হয়? বেঞ্চে এসে বসেই খাতা খুলে
দেখতে লাগল। প্যারাগ্রাপে দুই, রি-এরেঞ্জে শূন্য, লেটারে শূন্য। প্যাসেজে সামারি
(সারমর্ম) লেখাতে পাঁচ নাম্বার ছিল। এটাতেও শূন্য। ব্যাপার কি? এই রকম নাম্বার
দেওয়ার কি মানে?
বুকে অনেক সাহস নিয়ে রাজু
দাঁড়িয়ে বললঃ স্যার, অনেক গুলো উত্তরে শূন্য দেওয়া। আমি ভুলটা বুঝতে পারছি না।
স্যারঃ ভুলটা যদি বুঝতে পারতে
তবে কি আর সেকেন্ড বয় হয়ে ফেইল করতে। খাতা নিয়ে এখানে আসো।
এতক্ষন ধরে রাজুর চোখ লাল হয়ে
ছিল, কিন্তু এইকথা শুনে তার কান পর্যন্ত লাল হয়ে গেল।
খাতা দেখে স্যার বললেনঃ প্যারাগ্রাপ এসেছে রেডিও এর গুরুত্ব। আর তুমি
এই গুলো কি লেখেছ।
রাজুঃ আমি একটা গল্প
পড়েছিলাম, রেডিও তে প্রচারিত যুদ্ধের একটা নাটককে নিজেদের দেশের যুদ্ধের খবর মনে
করে এক শহরের অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল। আমি এখানে এটাই লিখেছিলাম, যে রেডিও তে
প্রচারিত অনুষ্ঠান গুলো মানুষকে কিভাবে প্রভাবিত করে। তাছাড়া আমাদের স্বাধীনতা
যুদ্ধের সময় রেডিও অনেক হেল্প করেছে, অনুপ্রেরনা দিয়েছে - আর তাই এর গুরুত্ব অনেক।
স্যারঃ এসেছেন আমার
দেশপ্রেমিক গল্পকার! প্যারাগ্রাপ মানে কি গল্প? লেখতে হবে টেকনোলজি নিয়ে। তাছাড়া প্যারাগ্রাপ
এর স্ট্রাকচার আছে। খালি লেখলেই হয়না।
রাজুঃ তবে লেটারে শূন্য কেন?
সেটা তো আমি স্ট্রাকচার অনুযায়ী লেখেছি।
স্যারঃ “At fast take my salam.” ক্লাস নাইনে পড়ে First বানান পারিস না। ঐ লেটারে
শূন্য দিব না তবে কি ১০০ দিব।
(স্যার প্রথমে তুমি দিয়ে শুরু
করলেও পরে আপনি, আর এখন তুই বলতে শুরু করেছেন )
রাজুঃ আর রি-এরেঞ্জে শূন্য
কেন?
স্যারঃ প্রথমেই বলে দিলি
আইনস্টাইন মহা বিজ্ঞানী। তবে আর বাকি লাইন গুলো লেখার কি দরকার। ওইটা সবার শেষে
যাবে। তাই, অর্ডার ঠিক হয়নি।
এমন সব যুক্তির কাছে আর কোন
প্রশ্ন করা যায় না। রাগে দুঃখে হেড ডাউন করে বসে রইল।
অনেকেই অনুনয় করে স্যারের কাছ থেকে পাশ নাম্বার আদায় করে নিল। কিন্তু রাজুর আর সেই
ইচ্ছা হয়নি। ৬০ জনের মাঝে ১২ জন পাশ করেছিল। পরে জানতে পেরেছিল সেই বারো জন নাকি
স্যারের কাছে বিশেষ জন। স্যারের কথাই ঠিক। পরের বার রাজু আরে সেকেন্ড হতে পারেনি।
ক্লাস টেইনে তার রোল হয়েছিল পাঁচ।
এখন আর মনে সেই দুঃখটা নেই,
তবে সেই লজ্জা, ভয় আর অপমান আজও জমাট হয়ে আছে। আর রাজুর মাথায় একটা প্রশ্ন কেবল
ঘোরপাক খায়। “শুনেছি স্যারের ছেলেটি ক্লাস ফাইভে পড়ে। আচ্ছা, ছেলেটি কি স্যারের কাছেই কোচিং করে। নাকি তার খাতার কোনায়
লাল কালিতে লেখা থাকেঃ ৩২।”
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন