“স্যার, পেজ প্লিজ।”
পরীক্ষায় ১ ঘণ্টা যেতে না যেতেই তিন্নির খাতা শেষ হয়ে গেল। এক্সট্রা পেজ লাগবে। কথাটা শোনা মাত্রই রাতুলের মাথাটা গরম হয়ে গেল। তার সবে মাত্র প্রথম উত্তরটা লেখা হল, আর এর মাঝেই তিন্নির খাতা শেষ। খাতায় সে এত কি লেখে? সারা বছরে তো তিন্নির মুখ থেকে কোন কথাই শোনা যায় না। বছরের সব কথা যেন আজ লিখতে শুরু করেছে।
সাধারণত ক্লাসে তিন্নির কথা বলা মানে হচ্ছে “ও আচ্ছা”/ “বুঝতে পারলাম না”/ “একটু আস্তে কথা বল” ... এই ধরনের ছোট ছোট কথা। শুধুমাত্র কম্পাইলার ক্লাসে সে একদিন মিসকে প্রশ্ন করেছিল। সেই দিনটি রাতুল আজও ভুলতে পারেনা। ক্লাসের কিছুই মাথাই ঢুকছিল না, আর তিন্নি কিনা মিসের ভুল খোঁজার চেষ্টা করছিল। তিন্নি যখন প্রশ্ন করছিল তখন সবাই চুপ করে শুনছিল। শান্ত মেয়েটি যে এত সুন্দর করে লজিক দিয়ে তর্ক শুরু করতে পারে - তা কেউই জানত না ।
“প্রশ্ন কেমন হয়েছে?” – স্যার হাসি মুখে জানতে চাইলেন।
“জ্বী, স্যার। প্রশ্ন খুবই ভাল হয়েছে।” – রোমনও হাসিমুখে বলল।
রাতুলের মাথাটা আরো গরম হয়ে গেল। স্যারকে এতটা তেল দেওয়ার কোন মানে আছে। প্রশ্নের আগা গোঁড়া কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মনে হয় পি এইচ ডি করতে গিয়ে যে প্রশ্ন গুলো নিজে পারেনি, সে গুলোই আমাদের দিয়ে দিয়েছে। আর রোমনের কাছে এটা নাকি ভাল প্রশ্ন!
হঠাৎ করে রাতুলের কলমের কালি শেষ হয়ে গেল। সারা বছর একটি কলম দিয়েই লিখছে, তখন কালি শেষ হয়না; আর আজ পরীক্ষার সময় তা শেষ হয়ে গেল। আশেপাশের কার কাছ থেকে কলম নেওয়া যায় কিনা তা দেখার জন্য রাতুল চারদিকে তাকাচ্ছে। চোখ গিয়ে পড়ল সুমিতের উপর। পরীক্ষার হলে যেন সে ষ্টেশনারী দোকান দিয়ে বসেছে। বাহারি রঙের মার্কার, কলম, পেন্সিল, রাবার, কাঁটার, স্কেল, পানির বোতল, স্টেপলার – সব নিয়ে হাজির। পরীক্ষার খাতাটি মনে হয় তার কাছে ছবি আঁকার ক্যানভাস। যাই হোক, সুমিতের কাছ থেকে কলম নিয়ে রাতুল আবার লেখা শুরু করল।
“রা _ _ তু _ _ ল। রা _ _ তু _ _ল” – কে যেন পেছন থেকে আস্তে আস্তে ডাকছে। ধুর, পেছন ফিরে তাকালেই কিছু না কিছু বলতে হবে, তারচেয়ে বরং লেখার ভাব নিতে থাকি।
একটু পর একটা সুরেলা কন্ঠ শুনতে পেল।
“রাতুল, ৪ নং প্রশ্নের উত্তর কি? 4.29?” যাক, অবশেষে ক্লাসের সুন্দরী মেয়েটা রাতুলের সাথে কথা বলল। তার ডাকে তো সাড়া দিতেই হবে। কিন্তু রাতুল তো নিজেই জানে না সেটার উত্তর কি। কিন্তু না বলতে পারলে তো হবে না। কিছু একটা বলতে হবেই। রাতুল একটু ঘুড়িয়ে বললঃ
“তোমারটা হয়েছে, তবে পুরোপুরি হয়নি। 4.27829 হবে”।
মেয়েটা এক বাক্যে সেটা বিশ্বাস করল, আর ভুল কোথায় হয়েছে সেটা খুঁজতে শুরু করল। সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে এই এক সমস্যা, সেলফ কনফিডেন্স খুবই কম থাকে। কেউ তাকে সুন্দরী বললেই বিশ্বাস করে, আর সুন্দর না বললে সেটা আরো বেশী বিশ্বাস করে।
“এই ছেলে, কথা বল কেন? সামনে চলে আস।”
রাতুলের কপালটাই খারাপ। প্রত্যেক পরীক্ষায় সে স্যারদের চোখে পড়ে যায়। অথচ সামাদ আর ফারুক ধুমসে কথা বলছে। ওরা আসলেই কথা বলার ওস্তাদ। কথা বলাও যে একটা আর্ট তা তাদের দেখলে বোঝা যায়।
রাতুলের কপালটাই খারাপ। প্রত্যেক পরীক্ষায় সে স্যারদের চোখে পড়ে যায়। অথচ সামাদ আর ফারুক ধুমসে কথা বলছে। ওরা আসলেই কথা বলার ওস্তাদ। কথা বলাও যে একটা আর্ট তা তাদের দেখলে বোঝা যায়।
পরীক্ষা শেষের দিকে চলে আসছে।
স্বপন খাতা জমা দিয়ে বের হয়ে গেল। অথচ আরো ১৫ মিনিট বাকি। কোথায় বসে রিভিশন দিবে বা বন্ধুদের হেল্প করবে – তা না, স্বপন বাবু সুন্দর হেঁটে হল থেকে বের হয়ে গেল। স্বপন আসলেই সত্যিকারের ব্যবসায়ী ছেলে। সময়ের মূল্য বোঝে। তাই, হলে বসে সময় নষ্ট না করে, বাবু সোজা চলে যাবে পাইকারি বাজারে। ব্যবসায়ীর ছেলে হওয়ায় ক্লাসের অনেকেই তাকে বাবু/বাবু সাহেব বলে ডাকে।
সময় শেষ হয়ে আসছে, আর এতক্ষনে রাতুলের ছয় নম্বর প্রশ্নটা চোখে পড়ল। অপর পাতায় যে প্রশ্ন আছে, সেটা রাতুল খেয়ালই করেনি। এখন আর কি করা, ডানে বামে না তাকিয়ে ধুমসে লেখা শুরু করে দিল। নাহ, রাতুলের কপালটা আজ আসলেই খারাপ। খাতা শেষ হয়ে এসেছে। এখন এক্সট্রা পেজ নিতে গেলে সময় আরো বেশী নষ্ট হবে। বাধ্য হয়ে ছোট ছোট করে লিখতে শুরু করল। কিন্তু শেষ আর করা হল না।
পরীক্ষা শেষ।
হল থেকে সবাই হতাশ হয়ে বের হল। কেউ A গ্রেড পাবে না তাই হতাশ, আর কেউ হয়ত পাশ করতে পারবে না তাই হতাশ। রাতুলের মাঝে কোন ভাবান্তর নেই। এক রাত্রি পড়ে এত কিছু লিখতে পারল, আর কি দরকার! পাশেই রোমনটা চেচ্চাচ্ছে। তার একটা প্রশ্নের উত্তর করা হল না। আরে ব্যাটা, এই জীবন থেকে প্রতিদিন কত প্রশ্নের উত্তর হারিয়ে যাচ্ছে, তাতেই কিছু হচ্ছে না – আর এটা তো কেবল একটা পরীক্ষার প্রশ্ন।
অবশেষে তাদের শেষ এক্সামটাও শেষ হয়ে গেল। সবাই মিলে শহীদুল্লাহ হলের পুকুর পাড়ে গিয়ে বসল। সবাই খুব গম্ভীর হয়ে আছে। ঝিরঝির বৃস্টি হচ্ছে। তাই, পুকুর পাড়ে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুধুমাত্র রাতুলরা বসে আছে - যারা কাল থেকে বেকার পরিচয় নিয়ে ঘুরবে। স্যার তাদেরকে আগেই বলে দিয়েছে - তোমাদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না। কিন্তু কাল থেকে তারাই জীবন যুদ্ধে নামবে, কিছু একটা করে বেঁচে থাকার জন্য। হয়ত অনেকেই সেই যুদ্ধে জয়ী হবে, আর কেউ হেরে যাবে।
কিন্তু সে সব নিয়ে এখন তারা ভাবছে না। বিকেলের আলো ফুরিয়ে আসছে, আর তারা ভাবছে আর কি কোনদিন দেখা হবে, নাকি হারিয়ে যাবে এই বিকেলের আলোর মত।
পুকুর পাড়ে বসার জন্য তিন্নি পেছনে এসে দাঁড়াল। কিন্তু পাড়ে খুব ময়লা পড়ে আছে।
"একটা পেজ হবে" - রিমি বলল।
"কেন তোর লেখা শেষ হয়নি। আরো লিখবি?" রাতুলের কথাটা শুনেই সবাই হাসতে শুরু করল।
বৃস্টি থেমে গেছে। আর রাতুলদের পিছনেই আকাশে রামধনু উঠেছে। আজ আর কেউ পিছনে ফিরে তাকাচ্ছে না। কিন্তু কেউ একটি বারের জন্য পিছনে ফিরে তাকালেই হয়ত দেখতে পারত, সাত রঙের রঙিন রামধনু।
![]() |
Curzon Hall |
লেখাটি আসলেই অনেকের জন্যে সত্যি
উত্তরমুছুন