কেন আমাকে ভয় পেতে হয়?

“হাই, বিপাশা, ব্যস্ত নাকি?” - বিপাশার অফিসের ডেস্কের সামনে এসে আসলাম সাহেব হেসে জিঙ্গেস করেলেন।
“না, স্যার। আজ আর তেমন কোন কাজ ছিল না। আপনি কিছু বলবেন?”
“গুড। তাহলে আমার রুমে চল, আগামী কালকের মিটিংটা নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলি।” - আসলাম সাহেবের হাসিটাই বলে দিচ্ছে তিনি এখন গল্প করার মুডে আছেন।
কিন্তু বিপাশা কিছুটা ইতস্তত করছে, কি বলবে বোঝতে পারছে না। ঈদের ছুটির পর আজই প্রথম অফিস। তাই অফিসে তেমন লোক নেই। তারপর এখন আবার অফিস ছুটির সময়। এই সময়ে আসলাম সাহেবের রুমে গিয়ে কথা বলার কোন আগ্রহ বিপাশার নেই। তাছাড়া এই লোকটিকে বিপাশার কখনই সুবিধার মনে হয়না। লোকটি কখনও কোন খারাপ কাজ করেনি, তবে লোকটি যে বিপাশাকে সর্বদা ফোলো করে সেটা সে ঠিক তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দ্বারা বোঝতে পারে।
“স্যার, আমরা কি কাল এটা নিয়ে কাল কথা বলতে পারি। আজ আমি একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে চাচ্ছিলাম। আজকে রাস্তাঘাট একবারে খালি।” - লোকটিকে ভদ্র ভাবে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে বিপাশা।
“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো। ঈদের পর আজই প্রথম অফিস, অনেক লোকেই আসেনি, রাস্তায়ও তেমন লোক নেই। তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটাই বেটার। তুমি চাইলে আমি তোমাকে লিফট দিতে পারি।”
“না, স্যার, তার দরকার হবে না। আমি চলে যেতে পারব।”
“ওকে।” - আসলাম সাহেব মুখটা কালো করে ফিরে চলল। মনে মনে বিপাশা একটু স্বস্তি পেল। যাক লোকটির কাছ থেকে সহজেই নিস্তার পাওয়া গেল।
আর দেরী না করে বিপাশা তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বের হয়ে বাস স্ট্যান্ডে চলে এল, আর মনে মনে বলতে লাগল, "হে খোদা বাসটি যেন তাড়াতাড়ি চলে আসে।" কিন্তু অনেকক্ষণ চলে যাওয়ার পরও বাসের দেখা পাওয়া গেলনা। এদিকে কি করবে কিছুই বোঝতে পারছে না বিপাশা। রাত হয়ে যাচ্ছে, রাস্তায় লোকজন কম। রিক্সার দেখাও পাওয়া যাচ্ছেনা। আর রিক্সা পাওয়া গেলেও ভাড়া হয়ত অনেক বেশী হবে। ঈদের মধ্যে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে, এখন আবার রিক্সা করে গেলে আরো অনেকটা টাকা চলে যাবে।
এই সব চিন্তা করতে করতেই বিপাশা দেখতে পেল একটি বাস আসছে। বাসটি আসতেই বিপাশা বাসে উঠে পড়ল। কিন্তু বাসে উঠেই বিপাশা দেখতে পেল বাসে মাত্র কয়েকজন প্যাসেঞ্জার বসে আছে। তাদের বেশীর ভাগই মনে হচ্ছে শ্রমিক টাইপের মানুষ। দুই-একজন মনে হয় বিপাশার মতই অফিস থেকে বাসায় ফিরছে। বিপাশায় কেবল একজন মহিলা প্যাসেঞ্জার। বাসে উঠার সাথে সাথেই তারা সবাই বিপাশার দিকে বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকাল। হঠাৎ একটা অজানা ভয় বিপাশাকে ঘিরে ধরল।
আচ্ছা, বাসের লোকগুলো কি সত্যি আমাকে দেখছে, আমাকে নিয়ে কোন কিছু ভাবছে? কিন্তু আমাকে দেখার কি হল? আমি কি কোন অদ্ভুত পোশাক পড়েছি? নাকি আমি দেখতে অদ্ভুত। নাকি আমি একটি মেয়ে, আর এটাই তাদের আগ্রহের কারন? বিপাশা বাসের মাঝামাঝি একটা সিটে একলা বসে পড়ল। বিপাশা বুঝতে পারছে তার পাশের এবং পিছনের লোক গুলো তাকে বারবার দেখত।
সামনের সিটে বসে থাকা একজন হঠাৎ হাঁচি দেওয়ার সময় বিপাশার দিকে একপলক তাকাল। বিপাশার মনে হল লোকটি ইচ্ছা করে তার দিকে তাকানোর জন্যে হাঁচি দিয়েছে। মানুষ এই ধরনের আচরণ কেন করে? এই ধরনের অদ্ভুত আচারন করে মানুষ কি মজা পায়?
একটু পরই বাসের একজন লোক তার পাশের জনকে বলে উঠে,
"আজকেরটা কিন্তু কালকের থেকে ভাল। "
"ঠিক বলছিস। এইটাকে কিছুতেই মিস করা যাবে না।" - বলেই লোকটি হাসতে শুরু করল। পাশের লোকটিও তার সাথে হাসতে শুরু করল।
বিপাশা লোকগুলোর কথায় কান দিতে চাচ্ছে না, কিন্তু শুনতে তো হচ্ছেই। কথা গুলো শুনেই বিপাশার মনের মাঝে একটা ঘৃনা জন্মে উঠে। এই লোক গুলো কি মানুষ? এই লোকগুলো কি ভাবে একটি মেয়েকে নিয়ে? ঘৃনার সাথে সাথে এই মানুষ রূপী জানোয়ার গুলোর জন্যে বিপাশার মনে সেই অজানা ভয়টা আবার শুরু হয়। তার হাতের তালু ঘামতে থাকে। পায়ের পাতা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
ঠিক তখনি আরেক জন ২৫-২৬ বয়সের প্যাসেঞ্জার উদাসীন ভাবে গান ধরে,
"তারে ধরব ধরব করেও, ধরতে পারছি না ..."
আচ্ছা, লোকটি কেন এই গান গাইছে? লোকটি কেন গান গাওয়ার সময় মুচকি মুচকি হাসছে আর আমার দিকে তাকাচ্ছে। লোকটি আসলে কি বোঝতে চাচ্ছে। লোকটি কি আমাকে নিয়ে মজা করছে? আমি কি বিনোদনের বস্তু?
হে খোদা, এরা সবাই এমন আচরণ করছে কেন। আমার মনে হয় বাসের প্রতিটি মানুষ একই কথা ভাবছে, একই চিন্তা করছে, তাদের মাথায় একই প্ল্যান কাজ করছে। যে মানুষটা একদম কিছুই করছে না, চুপ করে বসে আছে ভদ্র মানুষের মত, তাকে নিয়েও ভয় হচ্ছে।
একটু পর বাসের হেল্পার বাসের দরজাটা আগলে দাড়ায়। ১৩-১৪ বয়সের হেল্পার ছেলেটা বিপাশার ছোট ভাইয়ের বয়সের। কিন্তু এখন এই ছেলেটাকেও দেখে বিপাশার ভয় হচ্ছে।
চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। আশেপাশে আর কোন গাড়ি দেখা যাচ্ছে না। বাসটি কেবল ছুটে চলছে, আর সেই সাথে বিপাশার মাথায় চলছে নানা চিন্তা। বিপাশা লোক গুলোর চোখের দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছে। বিপাশা মনে মনে ভাবছে - তাদের সবাই যেন চোখে চোখে কথা বলছে তাকে নিয়ে।
আমি কি কিছু ভুল ভাবছি? হয়ত মানুষ গুলো অতি সাধারন, হয়ত কিছুই হচ্ছে না, হবে না, কিন্তু তবু আমার ভয় করছে কেন? আমি কেন ভয় পাচ্ছি? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? আমি কি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছি? যদি তাই হয়, তবে কে আমাকে পাগল করেছে, কে আমাকে এই রকম ভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করেছে। কেন আমাকে ভয় পেতে হবে?
দিনের পর দিন এই রকম হাজারো খবর আমাকে পড়তে হয়, নিউজ দেখতে হয়। তাই, অনেক কিছুই নিজ থেকে আমার ব্রেইন চিন্তা করে। আচ্ছা, আপনি কি আমার মত করে ভয় পান? আপনি কি আমার মত করে চিন্তা করেন? না, করেন না, কারন, খবরের কাগজ খুললেই প্রতিদিন যে খবর গুলো আমাকে ভাবায় আপনি সেগুলো নিয়ে ভাবেন না। প্রতিদিন এই ধরনের খবর পড়তে পড়তে আমার মাথায় এখন সত্যি এই সব চিন্তা ঘোরপাক খায়।
আমি কি নিরাপদ? আমি কি বাসায় নিরাপদে যেতে পারব? আর যদি বাসায় নিরাপদে যেতেও পারি, আমি কি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় এইসব চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারব?
“আপা, নামেন, ... আপানার স্টপেজ চলে আসছে।” - হেল্পার ছেলে চিৎকার করে বলে উঠে।
বিপাশা এতটাই অন্যমনস্ক ছিল যে খেয়ালই করেনি কখন চলে এসেছে। আরেকটুও দেরী না করে বিপাশা তাড়াতাড়ি বাস থেকে নেমে পড়ল। বিপাশা বাস থেকে নামার সময়ও দেখতে পেল লোক গুলো তার দিকে তাকিয়ে আছে।
রাস্তায় নেমেই বিপাশা বাড়ির গলির পথ ধরে হাঁটা শুরু করল। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। কোন লোক নেই। গলির মোড়ে আসতেই দেখতে পেল মাসুদের চায়ের দোকানটা বন্ধ। হয়ত ঈদের ছুটি কাটিয়ে এখনো সে ঢাকায় আসেনি। দোকানটি খোলা থাকলে এখানে অনেক লোক থাকত। বিপাশা দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল।
হঠাৎ বিপাশা পিছনে হাল্কা পায়ের শব্দ শুনতে পেল। কেউ তার সাথে সাথে আসছে, কিন্তু ধীরে ধীরে। বিপাশার পিছনে ফিরে তাকানোর সাহস হল না। সে রীতিমত দৌড়ে বাসায় পৌঁছে গেল।
দরজায় ধাক্কা দিয়ে বিপাশা বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল। বিপাশার বুকের ভেতরটা এখনও ধপ ধপ করছে। হঠাৎ বিপাশার কাঁধে একটা মানুষ হাত রাখে, আর ভয়ে চিৎকার করে পেছন ফিরে তাকায় বিপাশা।
“কি হল, মা? ভয় পেয়েছিস?”
বিপাশা আর কোন কথা বলতে পারেনা। তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে। তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।
“কি হয়েছে মা? আমাকে বল, কি হয়েছে?”
“কিছু না বাবা, কিছু না।”
বিপাশা কোনদিনই তার বাবাকে বলতে পারবে না তার কি হয়েছে, প্রতিদিন তাকে কিসের মাঝে দিয়ে যেতে হয়। সে কোনদিনই এই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাবেনা, কোনদিনেই স্বস্তির সাথে তার ঘরে ফিরতে পারবেনা।
প্রথম লেখা হয়েছিলঃ ৩০ শে শ্রাবন, ১৪২৬। (পরবর্তীতে সংশোধন করা হয়)
Dedicated to a mid-aged English lady who listened me and supported to write again.

মন্তব্যসমূহ